সর্বশেষ সংবাদ
যত মত তত পথ: বাংলা কি সত্যিই নিরাপদ?

যত মত তত পথ: বাংলা কি সত্যিই নিরাপদ?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক: 

 

মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের মানসিক দ্বন্দ্ব হয়েছিল- আত্মীয় - পরিজন,গুরুজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা নিয়ে। আর উইলিয়াম শেক্সপীয়রের বিখ্যাত নাটকে হ্যামলেটের তীব্র দ্বন্দ্ব হয়েছিল - "To be or not to be" নিয়ে।

আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের দামামা বেজে গিয়েছে, তখন আর একটা বড় দ্বন্দ্ব যুযুধান রাজনৈতিক পক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে - এই রাজ্য মহিলাদের জন্য নিরাপদ, নাকি নিরাপদ নয়! আর এই দ্বন্দ্বের রেষ ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। 

অতি সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।  এন. সি.আর.বি. র এই রিপোর্টে কলকাতা এক নাগাড়ে চতুর্থ বারের জন্য দেশের নিরাপদতম শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

মনে রাখতে হবে এন. সি.আর.বি. র এই রিপোর্টটি ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী এই শহরের প্রতি লাখ জনসংখ্যা পিছু আমলযোগ্য অপরাধের সংখ্যা ৮৩.৯ যা দেশের ১৯টি মূল শহরের ( যাদের জনসংখ্যা ২০ লক্ষের অধিক ) মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২১ সালে ৮৬.৫ সেগুলিও সর্বনিম্ন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ।

আর এই নিয়েই বেঁধেছে জমজমাট রাজনৈতিক তরজা। রাজ্যের ক্ষমতাসীন বা শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেস দৃশ্যতঃ ই এই রিপোর্টে উৎফুল্ল এবং আসন্ন নির্বাচনের আগে একে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার এবং ফায়দা লোটার জন্য উদগ্রীব।

অন্যদিকে বিরোধী দলগুলি, যারা ১৪ বছরের তৃনমূল শাসনকালে এই দাবি বা অভিযোগই করে আসছে যে একদা সাহিত্য - সংস্কৃতির শহর কলকাতা এক ক্রমশ সন্ত্রাসের শহর,ধর্ষনের শহর, নারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারের শহরে পরিণত হয়েছে, তারা এন. সি.আর.বি. র রিপোর্ট উল্লেখ করেই এই ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার খেলায় মেতেছে। অনেকেই বলেন, পরিসংখ্যান তত্ত্বের মজার ব্যাপার হল - এখানে সংখ্যাই মূল প্রতিপাদ্য নয়,মূল প্রতিপাদ্য হল তার ব্যাখ্যা একই পরিসংখ্যান ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পরিবেশন করে তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা করে, ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বা ন্যারেটিভ তৈরি করা যায়।

রাজ্যের বিরোধী দলগুলি এন. সি.আর.বি. র ২০২২ সালের রিপোর্ট টিকে বেছে নিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে ওই সালে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের সংখ্যা ৩৪,৭৩৮, যা চূড়ান্ত সংখ্যার বিচারে দেশের মধ্যে একদম অপরের সারিতে।

এখানে লক্ষ্য করে দেখুন, যে প্রথম ক্ষেত্রে একটি Ratio - লাখ জনসংখ্যা পিছু'র কথা বলা হয়েছে, যেটি একটি আপেক্ষিক সংখ্যা। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র চূড়ান্ত সংখ্যা বা সংখ্যার সাংখ্যিক মানকেই ধরা হয়েছে।

এখন বড় প্রশ্ন হল - আপনি কোনটাকে নিরাপত্তার মাপকাঠি বা মানদণ্ড ধরবেন?

ক্রিকেটীয় উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে - ধরুন বলা হল - অমুক দলকে জিততে গেলে ৩০০ রান করতে হবে। এখন যদি সেটা ২০ ওভারের খেলা হয় তাহলে ওভার পিছু ১৫ রান করতে হবে - যা যথেষ্ট High Asking Rate। আর যদি সেটা ৫০ ওভারের খেলা হয় - তাহলে Asking Run Rate নেমে দাঁড়ায় ৬-এ। যা এমন কিছুই নয়।

এখানে আরও অনেক মজার এবং গুরুত্বপুর্ন বিষয় আছে। বিরোধীরা বলছেন, ২২ সালে লাখ মহিলা পিছু তাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের সংখ্যা ৭১.৮, যা নাকি এক্ষেত্রে জাতীয় গড় - ৬৬.৪ এর চেয়ে বেশী। এখানে লক্ষ্যনীয়, ২০২৩ সালের যে রিপোর্টে কলকাতাকে নিরাপদতম বলা হয়েছে তাতে দেশের ১৯ টি এমন শহরকে ধরা হয়েছে যাদের জনসংখ্যা ২০ লাখের অধিক। আর পরেরটিতে গোটা দেশের কথা ধরা হয়েছে। কাজেই এই দুটি ফলাফলে বা ব্যাখ্যায় গড়মিল স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী।

কিন্তু Indian Institute for Human Settlemet এর ২০২৪ সালে করা রিপোর্টে অন্য একটি ওরুত্বপূর্ণ তথ্য ধরা পড়েছে। এতে বলা হয়েছে ঝুঁকির দিক থেকে দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে "women's Risk Index' ৮.২ (১০ এর মধ্যে) , যা খুবই বেশি। পূর্ব ভারতে সর্বোচ্চ। এতে বলা হয়েছে মহিলাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের মাত্র ৩০ শতাংশ নথিভুক্ত করানো হয়।

এই নিম্ন অনুপাতের পিছনে দায়ী চাপ, ভয়, সন্ত্রাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব। এই পরিসংখ্যান বা তার ব্যাখ্যা সত্যি হলে তো কিন্তু এক ভয়ংকর বার্তার ইঙ্গিতবাহী। বলা যেতে পারে ঈশান কোণে মেঘ জমার ঈঙ্গিত।

'সত্যি' যদি ভয়ঙ্কর ও হয়, তবু তা প্রকট হোক, বেরিয়ে আসুক-তবেই তার মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু তাকে অস্বীকার করলে বা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে সমস্যা সমাধান হয় না। ঠিক একই ভাবে সত্য কে মিথ্যা বা সত্যের অপব্যাখ্যার খেলাও বন্ধ হোক।

পরবর্তী খবর